নজর২৪ ডেস্ক- এক তরুণকে পুলিশ ফাঁড়িতে এনে টাকার জন্য নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠেছে সিলেট মহানগর পুলিশের বিরুদ্ধে। নিহত রায়হান আহমদ (৩৪) সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার গুলতেরা মঞ্জিলের বাসিন্দা। তিনি দুই মাস বয়সী এক সন্তানের জনক। নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. আবদুল গফফারের চেম্বারে তিনি চাকরি করতেন বলে জানা গেছে।
রায়হানের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ প্রচার করে, গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ওঠার পর নিজেদের বক্তব্য পাল্টে পুলিশ জানায়, নিহত তরুণ ছিনতাইকারী গ্রুপের নির্যাতনের শিকার। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম ও চাচা হাবিবুল্লাহ অভিযোগ করেছেন, কর্মস্থল চিকিৎসকের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরি দেখে গতকাল শনিবার রাত ১০টায় রায়হানের মোবাইলে ফোন দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে মায়ের মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল আসে। ফোনের ওপার থেকে রায়হান জানান, পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে এসে ১০ হাজার টাকা দাবি করছে। টাকা না পেলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ আজ রোববার ফজরের সময় টাকা নিয়ে ভাতিজা রায়হানকে ছাড়িয়ে আনতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান। এ সময় সাদা পোশাকে ফাঁড়িতে থাকা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আপনার ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসার কথা। আপনি ৫ হাজার টাকা নিয়ে আসলেন কেন? চলে যান, রায়হান এখন ঘুমাচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও ফাঁড়িতে নেই। আপনি ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল ৯টার দিকে আসেন। আসলেই তাকে নিয়ে যেতে পারবেন। তাকে আমরা কোর্টে চালান করব না।’
রায়হানের চাচা জানান, সকাল ৯টার দিকে টাকা নিয়ে তিনি ফের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। এ সময় পুলিশ সদস্যরা জানান, অসুস্থ হয়ে পড়ায় সকাল ৭টার দিকে রায়হানকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরে হাবিবুল্লাহ উদ্বিগ্ন হয়ে তৎক্ষণাৎ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, রায়হানের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর বিকেল ৩টার দিকে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে।
‘পুলিশি নির্যাতনে’ রায়হানের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন আজ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় আধাঘণ্টা সড়ক অবরোধের পর পুলিশ তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
এদিকে আজ ভোরে রায়হানের মৃত্যুর পর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ছিনতাইকালে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর তৎপর হয় মহানগর পুলিশ। নিজেদের বক্তব্য বদলে তারা জানায়, ছিনতাইকারী একটি গ্রুপের নির্যাতনের শিকার রায়হানকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন দাবি করেন, ভোররাতে এএসআই আশিক এলাহির নেতৃত্বে রায়হানকে উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইকারী একটি গ্রুপ তাকে নৃশংসভাবে নির্যাতন করে ফেলে রাখে। রায়হান নিজেও ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত বলে দাবি করে তিনি জানান, কোতোয়ালি থানায় তার নামে দুটি মামলা আছে, তিনি মাদকও গ্রহণ করতেন। তাকে ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতনের প্রশ্নই আসে না। সিসি টিভির ফুটেজ দেখলেও এমন অভিাযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে বলে তিনি দাবি করেন।
তবে পুলিশ যেখানে গণপিটুনির কথা বলছে, সিটি করপোরেশনের সিসি টিভি ফুটেজে ওই এলাকায় এমন কোনও ঘটনার সত্যতা মেলেনি। এঘটনায় রোববার দিবাগত রাত আড়াই টায় সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করছেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি।
এ মামলাটি রুজু করেছেন কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) সৌমেন মৈত্র। মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়েছে। রাত সাড়ে ৩টায় মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নিহত রায়হানের মামাতো ভাই আব্দুর রহমান।
এদিকে, নগরীর কাষ্টঘর এলাকা সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৪ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকার পুরোটাই সিসিটিভির ক্যামেরার আওতাভুক্ত। এসব ক্যামেরার মনিটর রয়েছে ১৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিমের কার্যালয়ে।
রোববার রাতে মুনিমের কার্যালয়ে গিয়ে শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত কাষ্টঘর এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। এসব ফুটেজে কোনো গণপিটুনির ঘটনা দেখা যায়নি। এমনকি এই সময়ে কাষ্টঘর এলাকায় পুলিশের কোনো টহলও দেখা যায়নি।
কাউন্সিলর মুনিম বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ দেখেছি। শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত ওই এলাকার ফুটেজে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। এছাড়া আমি কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সাথে কথা বলেছি। তারাও এরকম কিছু ঘটেছে বলে শুনেননি।
এছাড়া কাষ্টঘর এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা কেউই রাতে বা ভোরের দিকে কোনো গণপিটুনির কথা শুনেননি। কোনো চিৎকার চেঁচামেচিও শুনেননি তারা। তবে সকালে কাষ্টঘর পূজামণ্ডপের আশপাশের এলাকায় পুলিশ গিয়ে টহল দেয় বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
কাষ্টঘর পূজা মণ্ডপের পাশেই বাসা আইনজীবী সুমিত শ্যাম পলের। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রায় রাতেই এই এলাকায় মাদকসেবীদের চেঁচামেচি শোনা যায়। পুলিশের বাঁশির শব্দও শোনা যায়। তবে শনিবার রাতে বা রোববার ভোরে এমন কিছু শুনিনি। গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে তো চিৎকার শোনা যেতো।