চট্টগ্রাম নগরের ষোলোশহর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। এটির পাশে ছোট একটি কনফেকশনারি দোকান। আর দোকানের ক্যাশে বসে আছেন এক যুবক। মালামাল ক্রেতাদের হাতে তুলে দিয়ে টাকা নিচ্ছেন। ওই যুবকের নাম মো. শরীফ উদ্দিন। আট মাস আগে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) উপসহকারী পরিচালক ছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়।
শরীফ বিভিন্ন তদন্তের শুরু থেকেই প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়েছিলেন বলে দাবি করেন। সে কারণেই তাকে চাকরি হারাতে হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
চাকরি হারানোর ৮ মাস পর এখন শরীফ উদ্দিন পুরোদস্তুর দোকানি। কাজ করছেন ভাইয়ের দোকানে।
চাকরিরত অবস্থায় হুমকি পেয়েছিলেন জানিয়ে শরীফ বলেন, ‘‘ওদের কথাই সত্য হলো, ‘রাস্তার ফকির বানাবে।’ বানাইছে। দোকানদার বানাইছে। দোকানদার- খারাপ কিছু না। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
শরীফ জানান, চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি চাকরি থেকে অপসারণের পর নানা সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরির চেষ্টা করলেও চাকরি পাননি। পরে সংসার চালাতেই বড় ভাইয়ের পরামর্শে দোকান পরিচালনার দায়িত্ব নেন তিনি।
তবে বড় ভাইয়ের দোকানে কাজ শুরুর পেছনে চিকিৎসকের পরামর্শও কাজ করছে বলে জানান শরীফ উদ্দিন।
সোমবার চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্মের ডান পাশের ছোট্ট কুলিং কর্নারের দোকানে কথা হয় শরীফের সঙ্গে।
শরীফ উদ্দিন দুদকের সহকারী পরিচালক থাকা অবস্থায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া নিয়ে অনুসন্ধান, সরকারি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের দুর্নীতিসহ নানা স্পর্শকাতর বিষয়ে অনুসন্ধান ও মামলা করে আলোচিত হন।
‘রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে মামলার’ পর অভিযুক্তদের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে চাকরিচ্যুত করে দুদক তাকে পুরস্কৃত করেছে বলে মনে করেন শরীফ। বলেন, ‘কমিশনের অনুমোদন নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। শুরুতে কমিশন সহযোগিতা করেছে। নথিগুলো আমাকে বিশ্বাস করে দিয়েছে। কিন্তু যখন প্রতিবেদন দাখিল করেছি, কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ মামলায় যখন অভিযুক্তদের নোটিশ করলাম, তখন থেকে মূলত ওরা আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপেছে। ওরা আমাকে ম্যানেজ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু আমি গ্রহণ করিনি। ম্যানেজ না হওয়ায় ওরা বুঝে গেছে।’
তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে প্রভাবশালীদের চেহারা বদলে যায় বলে জানান। বলেন, ‘একটার পর একটা অভিযোগ দাখিল শুরু হলো। এমনিতে এখান (চট্টগ্রাম) থেকে বদলি হওয়ার সময় কোনো অভিযোগ ছিল না। আমার রুটিন বদলি ছিল, কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে আমাকে বদলি করা হয়নি।
‘চাকরিচ্যুতের ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে আমার জিইসির মোড় এলাকার বাসায় গিয়ে আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। তখন কমিশনকে আমি সবকিছু জানিয়েছি, তাদের সাপোর্ট এটাই যে, আমার চাকরি চলে গেছে। কেন জানাতে গেলাম, কেন চট্টগ্রামে আসলাম। শুধু আমি না, আমার পটুয়াখালী জেলা পরিচালককে শোকজ করা হয়েছিল, কেন আমাকে ছুটি দিল। ছুটি পাওয়া তো আমার অধিকার।’
ভাইয়ের পরামর্শে তার দোকানে দেড় মাস আগে কাজ শুরু করেন শরীফ উদ্দিন। দোকানে দাঁড়িয়েই কথার ফাঁকে ফাঁকে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী হাতে তুলে দিচ্ছিলেন নানা সদাই। সেই সদাইয়ের মূল্য সংগ্রহ করে রাখেন নির্ধারিত ক্যাশবাক্সে। কর্মচারীদের বুঝিয়ে দেন নানা ফরমায়েশ।
চাকরি না থাকলেও সব সময় ভয়ে দিন পার করছেন বলেও জানান শরীফ। তার বেঁচে থাকাটা সেই প্রভাবশালী মহলের জন্য হুমকির মতো বলে ভাবনা তার।
প্রভাবশালীরা এখন নিয়মিত তার বিরুদ্ধে কমিশনে লাগাতার অভিযোগ করে যাচ্ছেন বলে জানান। কেননা অভিযোগ থাকলে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা কঠিন হবে।
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘যে নথিগুলো আমি সুপারিশ করেছি, সেগুলো এখনো দায়িত্বপ্রাপ্তরা শেষ করতে পারেনি। পক্ষে-বিপক্ষের বিষয় না, আমাদের বিষয়গুলো নির্ভর করে প্রমাণের ওপর। তারা মনে করতেছে, আমার কারণে রিপোর্টগুলো নিজেদের পক্ষে আনতে পারছে না। আমাকে হুমকি মনে করতেছে। যদি আমি বেঁচে থাকি বা দেশে থাকি, তাহলে নথিগুলো ভবিষ্যতে কী হবে।
‘মামলা যদি আমি করি বা আমি তদন্ত কর্মকর্তা হই, তাহলে কোর্টে আমাকে সাক্ষী দিতে হবে। অনেক মামলার চার্জশিট দিছি আমি ময়মনসিংহ আর চট্টগ্রামে। সেগুলোতে কোর্টে আমাকে দাঁড়াতে হবে। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী বলবে, আমি বিতর্কিত হওয়ায় দুদক আমাকে চাকরিচ্যুত করছে, সুতরাং আমার মামলাও মিথ্যা। তখন তো এটা তাদের পক্ষে যাবে। এই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী?’
এখনও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না বলে জানান দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তা। বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চলতে হয়, তাদের গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। আমার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর সময় চিন্তা করতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়ছে। যেহেতু আমি কোনো চাকরিতে যোগদান করতে পারিনি, এখনো জীবিত আছি, আমার জীবিত থাকাটাই ওদের জন্য বড় হুমকি বলে ওরা মনে করতেছে।’
সাধারণ মানুষের অভিব্যক্তি সম্পর্কে শরীফ বলেন, ‘যারাই আমাকে চেনেন, তারা আমাকে এখন অভিনন্দন জানাচ্ছেন। বলছেন, আপনি হালাল ব্যবসা করছেন। অনেকে দেশের টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করে। আপনি সেই পথে না গিয়ে হালাল একটি ব্যবসা করছেন। এটাই সবার জন্য শিক্ষা হওয়া উচিত।’
পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ভেটেরিনারি ডাক্তার ছিলাম। আমি চাইলেই তো আগের মতো চলতে পারবো না। আমার ফ্যামিলি আমার দিকটা বিবেচনা করে। বাচ্চাদের আমি মুখ দেখাতে পারি না। আগে বিভিন্ন অনুসন্ধান নিয়ে রাতের পর রাত কক্সবাজারে থাকতাম। এখন বাসায় বসে থাকি। এখন সন্তানরা প্রশ্ন করে, বাবা তুমি এখন কক্সবাজার যাও না? যখন কয়েকজন লোক আমার বাসায় এসে আমাকে হুমকি দিয়ে গেলো, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর আবার বাচ্চা আমাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা তোমাকে মারতে আসছে কেন? তুমি কাঁদো কেন? আসলে এগুলোর কোনো উত্তর নেই।’