নজর২৪ ডেস্ক- ২০০৯ সালের মার্চ মাসের পর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত করেছে, সেপ্টেম্বরে দেশের কোথাও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। অর্থাৎ সাড়ে ১১ বছর পর ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ মুক্ত মাস পেল বাংলাদেশ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোই বলছে, বন্দুকযুদ্ধের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছ, এমন খবর তাদের কাছে নেই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ২০০২ সালের শুরুতে অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এরপর ২০০৪ সালে থেকে র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের একের পর এক ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর হিসাবে ২০০১ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৩ হাজার ৪৪ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বাড়ে।
গবেষকরা বলছেন, এই ঘটনায় প্রমাণ হয় সরকার চাইলেই এধরনের বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড রুখে দেয়া সম্ভব। সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, ক্রসফায়ার কোন সমাধান না। ক্রসফায়ারের নামে সবার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়।
তবে এই দুই মাসের চিত্র দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক মাসে বন্দুকযুদ্ধ না হওয়ায় স্পষ্ট যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী চাইলেই ক্রসফায়ার ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সাবেক আইনজীবী এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ক্রসফায়ারের দরকার নেই, আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। আদালতের উচিত কথায় কথায় জামিন না দেয়া।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহিদুল হক বলেন, “কক্সবাজারের ঘটনার পর কেউ এখন আর এই বন্দুকযুদ্ধ চাচ্ছে না। সরকারও এটা চাচ্ছে না বলে আমার ধারণা। তাছাড়া পুলিশ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের নেতিবাচক কথা-বার্তা উঠায় বন্ধ হওয়াটা স্বাভাবিক।”
তিনি বলেন, “অনেক নামিদামি লোক আমাদের বলেছে, ক্রসফায়ার দেন, এসব রেখে লাভ কী? কিন্তু পুলিশ যখন বিপদে পড়ে তখন কেউ পাশে থাকে না।
“ক্রসফায়ারের পক্ষে আমরাও না, কিন্তু সত্যিকার অর্থে যখন কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে আক্রমণ করে তখন আত্মরক্ষা করা জায়েজ আছে। তবে কথিত ক্রসফায়ার না করাই ভালো, এ উপলদ্ধি মনে হয় এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসেছে।” ‘বন্দুকযুদ্ধ’ দিয়ে মাদক বন্ধ হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, র্যাব বরাবরই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘোর বিরোধী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যদি তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখনই জীবন রক্ষায় গুলি ছোড়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদকবিরোধী অভিযানে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে র্যাব এখন বেশি সফল। তবে বন্দুকযুদ্ধের সঙ্গে মাদকবিরোধী অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই।
পুলিশের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানার কাছ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের আগে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সর্বশেষ দুই শিকার হলেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬) ও আবদুল মান্নান ওরফে মুন্না আহমদ (৩৫)। সিনহা মো. রাশেদ খান কক্সবাজারের টেকনাফে গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনার দুদিনের মাথায় ২ আগস্ট সিলেটের সুলতানপুরের অজগ্রাম এলাকায় নিহত হন আবদুল মান্নান।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম সাত মাসে পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে জানুয়ারিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ২১ জন। পরের মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে ২২টি। মার্চ মাসে ২৫টি, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে কর্মসূচি নিয়ে পুলিশ যখন ব্যস্ত সেই এপিল মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কমে আসে ১৫টিতে। পরের মাসে অর্থাৎ মে মাসে ২৭টি, জুনে ২৭টি এবং সিনহা যে মাসে নিহত হন সেই জুলাইয়ে এ বছরের সর্বোচ্চ ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে, মৃত্যু হয় ৪৭ জনের।