অন্তু দাস হৃদয়, স্টাফ রিপোর্টার- টাঙ্গাইলের চমচম শব্দটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রসালো স্বাদযুক্ত মিষ্টির প্রতিচ্ছবি। যুগ যুগ ধরে রসনা বিলাসী বাঙালির তৃপ্তিদায়ক মিষ্টান্ন এই সুস্বাদু চমচম। চমচম বলতে বাঙালি একবাক্যে বুঝে নেয় টাঙ্গাইল তথা পোড়াবাড়ীর প্রসিদ্ধ চমচমের কথা। রাষ্টীয় বা সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা বন্ধুদের আড্ডায়ও পোড়াবাড়ীর চমচম ব্যতিত আনন্দ পূর্ণতা পায়না।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীতে উৎপাদিত সেই বিখ্যাত চমচম বর্তমানে তার জন্মস্থানেই নিরুদ্দেশ হওয়ার পথে। টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টিপট্টীতে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম স্বল্প পরিসরে পাওয়া গেলেও মিষ্টির উৎপত্তিস্থল পোড়াবাড়ীতে অস্থিত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। পোড়াবাড়ীর প্রসিদ্ধ চমচমের যৌবনকালে গ্রামের ঘরে ঘরে শুধুমাত্র চমচম তৈরি হত। কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাত্র ১০-১২টি বাড়িতে চমচম তৈরি করা হয়। এর মধ্যে করোনা মহামারির থাবা সেগুলোকেও পথে বসিয়েছে। ইতোমধ্যে চমচম তৈরির বিখ্যাত কয়েকটি পরিবার ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
প্রসিদ্ধ চমচমের গোড়াপত্তনের কথা-
টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে ধলেশ্বরীর শাখা নদী এ্যালেনজানীর বামতীর ঘেঁষে সদর উপজেলার পোড়াবাড়ী ইউনিয়ন তথা পোড়াবাড়ী গ্রাম। ধলেশ্বরী নদীটি দাইন্যা ইউনিয়নের চারাবাড়ী ঘাট থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে চলে যাওয়ার আগে পোড়াবাড়ীর দিকে এ্যালেনজানী শাখা নদী তৈরি হয়েছে। প্রাচীণকালে প্রমত্তা ধলেশ্বরীর বামতীরে চারাবাড়ি নামক স্থানে গড়ে উঠে জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র। ব্রিটিশরা সবেমাত্র ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করেছে। ওই সময়ে ¯্রােতস্বিনী ধলেশ্বরী নদীর ঘাটে স্টিমার, লঞ্চ ও মালবাহী বড় বড় নৌকা নোঙর ফেলতো। সে সময় ঢাকা-কলকাতাগামী লঞ্চ-স্টিমারের ভেঁপুর উচ্চশব্দে চারাবাড়ি-পোড়াবাড়ির কূলবধূ থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ নারী-পুরুষ ‘জাহাজ’ দেখতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতো। নোঙর করা লঞ্চ-স্টিমার থেকে নেমে দেশি-বিদেশি হরেক রকমের মানুষ চারাবাড়ী ও টাঙ্গাইল শহরে কেনাকাটা করতো। কেউ সাদা চামড়ার, কেউ কালো, কেউবা লম্বা অথবা বেঁটে। এদের কেউ আবার শৌখিন পর্যটক, ব্যবসায়ী অথবা বেনিয়া- আমলা। ধলেশ্বরী নদীর ঘাট চারাবাড়ীতে থাকলেও পাশের পোড়াবাড়ীই ছিল প্রসিদ্ধ চমচমের আতুর ঘর। সে কারণে পোড়াবাড়ী ছিল জনসমাগমে ভরপুর। ধলেশ্বরী নদীর মাতৃস্নেহে গড়ে ওঠে লোভনীয় ও মোহনীয় মিষ্টি চমচম। তৎকালীন নদী কেন্দ্রীক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা পোড়াবাড়ীর চমচম মিষ্টি প্রেমিকদের রসনাতৃপ্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এ চমচম দেশ-বিদেশে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করে নেয়। পোড়াবাড়ীর এ চমচমই অবিভক্ত ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে টাঙ্গাইলকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।
টাঙ্গাইলের চমচম তৈরির মূল কথা-
টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টিপট্টী ও পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায় টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম তৈরিতে ধলেশ্বরী নদীর পানি, গরুর খাঁটি দুধ, দেশি চিনি (লালচিনি), লাকড়ীর চুলা, তেঁতুল কাঠের লাকড়ী ইত্যাদি উপকরণ লাগে। প্রথমে দুধ তেঁতুলের লাকড়ী দিয়ে জ্বাল করে ছানা তৈরি করতে হয়। দুধ থেকে তৈরিকৃত ছানা দিয়ে বিভিন্ন আকারের(সাইজ) কাঁচা চমচমের আকার দেওয়া হয়। অন্য চুলায় ধলেশ্বরীর পানির সাথে লালচিনি মিশিয়ে তেঁতুলের লাকড়ী দিয়ে জ্বাল করে ‘সিরা’ তৈরি করা হয়। এই সিরা তৈরির তাপই প্রসিদ্ধ চমচমের মূল কৌশল। তৈরিকৃত সিরার তাপ বুঝে তার মধ্যে কাঁচা চমচম দিয়ে পুনরায় সামান্য জ্বাল দিতে হয়। পরে চুলা থেকে নামিয়ে চমচম সহ সিরা ধীরে ধীরে ঠান্ডা করতে হয়। পরিশেষে চমচম থেকে বাড়তি সিরা ঝেড়ে চমচমের ওপর দুধের তৈরি মাওয়া ছড়িয়ে দিতে হয়। এ ভাবে তৈরি চমচমের বাইরের অংশ কিছুটা শক্ত হলেও ভেতরের অংশ মৌমাছির চাকের মত হয়ে একেবারে নরম হয়। এভাবেই প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরি করা হয়।
চমচম তৈরির ইতিহাস-
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর প্রসিদ্ধ চমচম প্রথম কে তৈরি করেছে তা নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারেন নি। জনান্তিকে জানা যায়, স্থানীয় দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম পোড়াবাড়িতে চমচম তৈরি ও বিক্রি শুরু করেন। আবার কেউ-কেউ মনে করেন, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে পোড়াবাড়ীতে চমচম তৈরি হতো। দশরথ গৌড়ের পর তার আত্মীয় রাজা রামগৌড়, নারায়ণ গৌড়, কোশাই দেব, দুই সহোদর মদন হালুই ও কোকন হালুই, মোহন লাল, শিব শঙ্কর গৌড়, প্রকাশ চন্দ্র দে সরকার প্রমুখ পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরি করতেন। এদের মধ্যে পাকিস্তান আমলে নারায়ণ গৌড় পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরি করে উপ-মহাদেশে প্রসিদ্ধ হন। বাঙালিদের মধ্যে চমচম তৈরি করে প্রসিদ্ধ হওয়ায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাকে ‘বাঙালি হালুই কর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর থেকেই তিনি বাঙালি হালুই কর হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকেই টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজার ‘মিষ্টিপট্টী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে তাদের তৈরি মিষ্টি কখনোই পোড়াবাড়ীর চমচমকে গুণে-মানে টপকাতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোড়াবাড়ী গ্রামের গোড়াপত্তনের পেছনে মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ নিয়োজিত শাসক পীর শাহজামানের কৃতিত্ব ছিল। ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যে ইসলাম খাঁ কাগমারী পরগনার শাসনভার শাহ্ জামানের উপর র্অর্পন করে ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে চারাবাড়ীতে লঞ্চ ও স্টিমার ঘাট স্থাপন করেন। পরে ওই ঘাটকে কেন্দ্র করে সেখানে ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। সে সময় চারাবাড়ীর গ্রামের দক্ষিণ অংশে ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বাজার ও বসতবাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর থেকে ওই এলাকাকে পোড়াবাড়ী বলা হত। কালক্রমে ওই পোড়াবাড়ী এলাকাই চমচমের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং পোড়াবাড়ী গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলে ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যসব জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে টাঙ্গাইলের চমচমের সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আরও জানা যায়, এ দেশিয় বহু বিখ্যাত ব্যক্তির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল পোড়াবাড়ীর চমচম। এদের মধ্যে রয়েছেন- শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাদু স¤্রাট পিসি সরকার, নবাব আলী চৌধুরী, জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরী প্রমুখ।
চমচমের বিদেশ সফর-
টাঙ্গাইলের চারাবাড়ীতে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ঘাট স্থাপনের পর এ এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশি-বিদেশি বণিক ও বেনিয়ারা টাঙ্গাইল থেকে পাট কেনার জন্য এসে পোড়াবাড়ীর চমচম নিয়ে বাড়ি ফিরতো। মূলত পোড়াবাড়ীর চমচমের পোড়া ইটের মত রঙ ও সুস্বাদু কড়া মিষ্টি এবং আবরণের ভেতর গোলাপী আভাযুক্ত নরম অংশ রসনা বিলাসীদের দৃষ্টি আকর্ষন করতো। এ ভাবে স্টিমার ও লঞ্চে সমগ্র ভারতবর্ষ সহ ব্রিটিশ কলোনীগুলোতে পোড়াবাড়ীর চমচম পৌঁছে যায়। ওই সময়টাই ছিল পোড়াবাড়ীর চমচমের যৌবনকাল। ওই সময় পোড়াবাড়ীতে ৩২টি মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মণ চমচম তৈরি ও বিক্রি হত। চমচম ও বিভিন্ন রকম মিষ্টি তৈরির জন্য পোড়াবাড়ীর প্রায় দুইশ’ পরিবার যুক্ত ছিল।
চমচমের সেকাল একাল-
চল্লিশের দশকে পোড়াবাড়ী সহ টাঙ্গাইলের পশ্চিমাঞ্চল ছিল চরাভূমি। ওই অঞ্চলের মানুষের একমাত্র পেশা ছিল কৃষি। ফলে ওই এলাকায় গরু-মেষ, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি গবাদি পশুপালন ছিল নৈমিত্ত্যিক। প্রাকৃতিক চরায় গবাদিপশুর খাওয়া-গোসল করাতেন প্রায় সব পরিবার। সে সময় গরুর দুধ সহজলভ্য ও সস্তা ছিল। পোড়াবাড়ীর চমচম তৈরির বয়োবৃদ্ধ কারিগররা জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের আমল থেকে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোট বেলায় তারা এক হাড়ি দুধের দাম দু’পয়সা থেকে ৪’পয়সায় বিকিকিনি হত। চিনি পাওয়া যেত ৩ আনা থেকে ৫ আনা সের দরে। এ ছাড়া ওইসব চিনি রেশনে দেয়া হত। আর চমচম বিক্রি হতো ৬ আনা থেকে ৮ আনা সের দরে। এর পর পরই যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীতে চর জেগে উঠতে থাকে। ফলে যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীতে ভাটা নেমে আসে। দিনে-দিনে ধলেশ্বরী নদী তার ভরা যৌবন হারাতে থাকে। একদা প্রমত্তা ধলেশ্বরী নদী তার বুকের সুধা ঢেলে দিয়েছিল চমচম তৈরির জন্য, সেই ধলেশ্বরী বর্তমানে বয়সের ভারে মৃত প্রায়। ধীরে-ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে তার ব্যাপ্তি। বন্ধ হয়ে গেছে চারাবাড়ী-পোড়াবাড়ীর সাথে নৌকা যোগাযোগ। ফলে পোড়াবাড়ী তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য হারিয়েছে। নিস্তব্ধ হয়ে মুখ থুবরে পড়েছে ঐতিহ্যের অতীত। ধলেশ্বরী ও এ্যালনজানী নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেছে প্রসিদ্ধ চমচমের প্রধানতম কাঁচামাল ধলেশ্বরীর মিঠা পানি। অর্ডার পেলে এখনও কারিগররা ধলেশ্বরী নদীর পানি এনে প্রসিদ্ধ চমচম তৈরি করে সরবরাহ করেন। তবে সে চমচমের দাম প্রচলিত চমচমের বাজার দরের কয়েকগুণ খরচ বেশি পড়ে। বর্তমানে পোড়াবাড়ীতে ৪টি ও চারাবাড়ীতে ৫টি মিষ্টির দোকান রয়েছে। এছাড়া পোড়াবাড়ী গ্রামে মাত্র ১০-১২টি পরিবার মিষ্টি তৈরির সাথে যুক্ত রয়েছেন। অন্যরা সুবিধাজনক পেশা বেছে নিয়েছেন। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু আগে ষাটের দশকে পোড়াবাড়ীর প্রসিদ্ধ চমচমের দাম ছিল সের প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা। চমচম ছাড়াও রসগোল্লা, অমৃত, কালোজাম, পানিতোয়া, সন্দেশ, দানাদার, রাজভোগ, রসমালাই, লালমোহন, ক্ষীর মোহন প্রভৃতি নামীয় মিষ্টি দোকানগুলোতে পাওয়া যায়। বর্তমানে চমচমের আগের সেই স্বাদ না থাকলেও মূল্য কেজি প্রতি ২০০-৩২০ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচমের প্রসিদ্ধির কারণে রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ‘পোড়াবাড়ীর চমচম’ নামে মিষ্টির দোকান শোভা পাচ্ছে। এসব মিষ্টির দোকানে ব্যবসায়ীরা টাঙ্গাইলের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টিপট্টী, আবার কেউ-কেউ পোড়াবাড়ীতে চমচম অর্ডার দিয়ে নিয়ে যায়। পরে তাদের সুসজ্জিত মিষ্টির দোকানগুলোতে সাজিয়ে ‘টাঙ্গাইলের চমচম’ বিক্রি করছে। টাঙ্গাইলের চমচমের প্রতি মানুষের দুর্বলতা থাকায় ওইসব মিষ্টি ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে।
চমচম সংশ্লিষ্টরা যা বলেন-
টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িতরা এ শিল্পকে ধরে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু অতি মুনাফালোভী কতিপয় মিষ্টি ব্যবসায়ীর কারণে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম ঐতিহ্য হারিয়ে অস্থিত্ব হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁচেছে। এ ছাড়া দক্ষ কারিগরের অভাবেও চমচমের গুণগত মান কমে গেছে। ফলে ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা পেশায় টিকে থাকতে ভেজাল চমচম তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে। এর উপর ‘মরার উপর খারার ঘা’ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে করোনা মহামারি। করোনা ভাইরাসের কারণে তিন মাস মিষ্টি তৈরি বন্ধ থাকায় শ্রমিক ও ছোট-ছোট ব্যবসায়ীরা পথে বসেছেন। তারা কী করে জীবিকা নির্বাহ করবেন তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। বাঙালি হালুই করের নাতি (মেয়ের ঘরের) গণেষ চন্দ্র গৌড় জানান, ১০০ বছর ধরে তাদের পরিবার চমচম শিল্পের সাথে জড়িত। বাঙালি দাদুর কাছে তার চমচম তৈরিতে হাতেখড়ি। দাদুর দেওয়া দোকান ‘আদি পোড়াবাড়ী মিষ্টান্ন ভান্ডার’ তিনি পরিচালনা করছেন। বাজার খারাপ হওয়ায় তিনি দোকানের অর্ধাংশ রেখে বাকি অর্ধাংশে মনোহরি দোকান করেছেন। তিনি জানান, পোড়াবাড়ীর চমচমের মূল রহস্য ধলেশ্বরী নদীর মিঠা পানি, গরুর খাঁটি ঘণ দুধ, লালচিনি ও দুর্লভ তেঁতুলের লাকড়ী এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ। এ সব সামগ্রী না পাওয়ায় সেই প্রসিদ্ধ চমচম তৈরি করা সম্ভব হচ্ছেনা। এ ছাড়া চারাবাড়ী-পোড়াবাড়ী শহর থেকে দূরে ও অপর্যাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে জনসমাগম কমে গেছে। মহান স্বাধীনতার পরেও তিনি প্রতিদিন ২-৩ মণ চমচম বিক্রি করতেন। বর্তমানে প্রতিদিন ২০-২২ কেজি চমচম বিক্রি করাও দূরূহ। পোড়াবাড়ী গ্রামে বাড়িতে চমচম তৈরি করেন বাঙালি হালই করের অপর নাতি(মেয়ের ঘরের) সাধন গৌড়। তিনি জানান, চমচমের আগের বাজার নেই। আগে ঢাকা সহ বিভিন্ন বড় শহর থেকে চমচম তৈরির অর্ডার পেতেন। বর্তমানে জেলার বাইরের কোন অর্ডার নেই। পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক না পাওয়ায় তিনি চমচম তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
টাঙ্গাইল জেলা হোটেল রেস্তোরা ও মিষ্টির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ জানান, মিষ্টিপট্টীতে তাদের চারটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। শ্রমিক ও কারিগর সহ ১১৭ জন ব্যক্তি তাদের কারখানায় কাজ করে। করোনার প্রভাবের আগে দৈনিক ১০-১২ মণ মিষ্টি বিক্রি হতো। এখন প্রতিদিন দুই মণ বিক্রি করাও কষ্টসাধ্য। করোনা মহামারির কারণে এ শিল্প ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। সরকারি সুবিধা দেওয়ার জন্য সমিতির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে ফরম পুরণ করে নিলেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ধীরে ধীরে বিক্রিও বাড়বে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রসিদ্ধ পোড়াবাড়ীর চমচম শুধুমাত্র রসনা তৃপ্তিতেই নয় ঐতিহ্যেও বিশ্বে অনন্য। এ চমচম তৈরির কারিগররা বংশ পরম্পরায় এর ঐতিহ্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ যাবৎকালে পোড়াবাড়ীর চমচম শিল্প কোন প্রকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। ফলে জন্মস্থানেই নিরুদ্দেশ হচ্ছে প্রসিদ্ধ পোড়াবাড়ীর চমচম। দেশের এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টরা সরকারি সহযোগিতা সময়োপযোগী পদক্ষেপের প্রয়োাজন অনুভব করছে।