ছেলে সৌদি প্রবাসী, পেট চালাতে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন ‘অসহায় বাবা’

মুক্তমত ডেস্ক- হাতিরঝিলের এফডিসি মোড়ের দিকটায় একটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ট্রাফিক চেকপোস্টের সঙ্গেই। কাল রাতে আমরা খেয়ে বেরোচ্ছি। মানে বিল যখন দিচ্ছি সেই সময় লোকটা এলো। চেহারা বিধ্বস্ত। ক্র্যাচে ভর দিয়ে রেস্টুরেন্টের ছেলেটার দিকে চেয়ে ইশারা করে যেভাবে খাবার চাইলো, তাতে মনে হলো দারুণভাবে ক্ষুধার্ত তিনি। আর ক্ষুধায় মাথা অনেকটা নিচের দিকে ঝুঁকে গেছে। এই ক্ষুধার জ্বালা আমি দারুণভাবে বুঝি। দানা না পড়লে, পেটের সামনের চামড়া মেরুদণ্ডের সঙ্গে লেগে যায়, এমন অনুভূতি আমার খুব পরিচিত।

 

রেস্টুরেন্ট থেকে ‘না’ করে দেওয়ার পরে আমরা উনাকে ভেতরে বসতে বললাম। উনি চেয়ারে বসেই কোকের যে বোতলটা একটু আগে আমরা খেয়ে রেখেছি, সেটা হাতে নিয়ে যতটুকু ছিল গ্লাসে ঢেলেই চুমুক দেওয়া শুরু করলেন। শুধু ক্ষুধার্তই নন, তৃষ্ণার্তও তিনি। রেস্টুরেন্টে জিজ্ঞেস করলাম- ভাত আছে কি না। ওরা জানালো ভাত নেই।

 

লোকটাকে ভাত খাওয়াতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ভাত নেই। বড় বড় লুচি রয়েছে। পরোটার সমান লুচি কয়েকটা আর একপ্লেট মাংস দিতে বললাম। এতে রাতের খাবার দারুণ হয়ে যাবে। লোকটাকে খেয়ে যেতে এবং বাই বলে চলে আসছিলাম। বাইক নিয়ে অনেকটা পথ আসার পর সানজিদা দ্বিতীয় দফায় বলল,

 

‘ভালো কাজ করেছ, লোকটা এতো ক্ষুধার্ত ছিল, লোকটাকে দেখে আব্বুর কথা মনে পড়ছিল।’ ‘হুম, আমার তো খারাপ লাগছে, আরো।’ ‘ওমা কেন?’ ‘উনাকে কিছু টাকা দিয়ে আসা উচিত ছিল। আমাদের তো ক্ষমতা নেই। সামান্য কিছু টাকা দিয়ে এলে, কাল সকাল থেকে দুই তিনদিন যদি খেতে পারতো।’ ‘হ্যাঁ, আসলেই ভালো হতো।’

 

এরপর বাসায় এসে চিন্তাটা বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল মাথায়। রাতে ঘুমের মধ্যেও অনেকবার ঘোরাঘুরি করেছে একটা অপরাধবোধ। ঘুম তুলনামূলক অন্যদিনের চেয়ে আগেই ভেঙেছে। নাস্তা খেয়েই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হাতিরঝিল এক চক্কর মারলাম, পেলাম না। তেজগাঁও-মগবাজারের রোড আইল্যান্ডগুলো খুব ভালো করে খুঁজলাম পেলাম না। হাতিরঝিলে ফের ঢুকলাম, এফডিসি মোড় হয়ে।

 

বাঁ-দিকের রেস্টুরেন্টের পাশেই গাছের আড়ালে দেয়ালঘেঁষে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে তিনি বসা। বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সকালে খাওয়া হয়েছে কি না। খাননি। খাবার এনে দিলাম। এরপর উনার সঙ্গে কথা বললাম, জানালেন মুক্তিযোদ্ধা তিনি। দেখলাম ময়লা, শতছিন্ন জামার এক কোণে একটা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোট পিন।

 

জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যুদ্ধ করেছেন; বললেন ৬ নম্বর সেক্টরে, হাসেম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি তাকে ঢাকা থেকে বগুড়া নিয়ে যান। তখন তার বয়স, ২২-২৩। বগুড়া থেকে হিলি বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকে ট্রেনিং নিয়েছেন। এরপর হিলি, জয়পুরহাট হয়ে, বগুড়া দত্তপাড়া, আর কি কি যেন বললো, ওইসব জায়গায় যুদ্ধ করেছেন। চালিয়েছেন এলএমজি। পরে নৌবাহিনীর চালক হিসেবে নাকি চাকরি করেছেন।

 

এখন নাকি তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান না। তার নাম নাকি তালিকায় নেই। পথে আসার ঘটনা সম্পর্কে বললেন। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, নব্বইয়ের কিছু আগে। তারপর মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যান। এরপর থেকেই পথে, পথে। তার অনেক কথা, রিপিটেশনে- দুই রকম হয়ে যাচ্ছিল। অনেক ক্ষেত্রে একটু উনিশ বিশ কথাও বলছিলেন। বিশেষ করে চাকরি ছাড়া কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ এর বিষয়ে। বরিশালের গৌরনদীর মানুষ, ছিলেন ছোট থেকেই ঢাকায়।

 

যাই হোক, এই পোস্ট না লিখলেও চলতো। বা ওপরের অনেক ঘটনাও অনেকের সঙ্গেই হয়, অনেকেই সহায়তা করেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো উনার ছবিসহ এই ঘটনা লিখি, কারণ তার তিনজন মেয়ে আছে, একজন ছেলে আছে। মেয়েরা কোথায় আছে জানেন না, ছেলে সৌদি প্রবাসী এই তথ্য জানেন। তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

 

এই পোস্ট লেখার বদলৌতে যদি তার কন্যাদের চোখে তাদের বাবার এই দুরবস্থার চিত্র যায়, যদি তারা বাবাকে গ্রহণ করতে চান। ফেসবুক লিখলে আজকাল অনেক কিছুই তো হয়ে যায়, তাই নয় কি? ও হ্যাঁ, উনার নাম আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার।

 

লিখেছেন- মাহাতাব হোসেন। সাংবাদিক, দৈনিক কালের কণ্ঠ। ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *