মনসুর আলম খোকন, সাঁথিয়া (পাবনা) প্রতিনিধি: সূর্য উঠার আগেই জেগে ওঠে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অভাবী দিনমুজুর মানুষ। কাজের সন্ধানে দূরদূরান্ত থেকে তারা ছুটে আসেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুরে অবস্থিত দুই শ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী হাটে কৃষিশ্রমিক হিসেবে বেচাকেনার জন্য। চোখে-মুখে তাদের অসহায়তার ছাপ। পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার দিতে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এই শ্রমজীবীরা।
এ হাটে এক শ্রেণির মানুষ আসেন ‘বিক্রি’ হতে আরেক শ্রেণির মানুষ আসেন শ্রমিক কিনতে। স্থানীয় ভাষায় তাদের দিনমুজুর বা কামলা বলা হয়। হাটে চলতে থাকে মানুষের দরদাম।পণ্যের দামের মতোই ওঠানামা করে প্রতিহাটবারের বাজার। এছাড়াও যুবক ও বয়স্ক শ্রমিকদের দামে কিছুটা পার্থক্য থাকে। বয়স্ক শ্রমিকের থেকে যুবশ্রমিকদের দাম প্রায় পঞ্চাশ থেকে একশ’ টাকা বেশি হয়ে থাকে।
কাশিনাথপুর শ্রমিকবাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের ভেতরের রাস্তার দুই পাশে ১৫ থেকে ৮০ বছর বয়সী হাজারো পুরুষের জটলা। গায়ে জীর্ণ পোশাক, হাতে কাস্তে নিড়ানী। অপেক্ষা নিজেকে বিক্রি করার। তবে দাস কিংবা পণ্য হিসেবে নয়। বেচাকেনা হয় শ্রমিক হিসেবে। শ্রম বিক্রির হাটে এরা সবাই পণ্য। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগেও ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নির্মম আঘাতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো আজও নিজেকে বিক্রি করেন শ্রমের হাটে। একাধিক কৃষকের সঙ্গে শ্রমিকরা চুক্তি অথবা দিনব্যাপী শ্রম বিক্রির পারিশ্রমিক নিয়ে দর-কষাকষি করছেন। চুক্তি শেষে কৃষকের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে কাজের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৫ থেকে ১০ জন দলবদ্ধ হয়ে আসেন। কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী যে কয়জন শ্রমিক দরকার সে কয়জন নেন। এ সময়ে পাট নিড়ানো, তিল কাটাসহ অন্যান্য কাজের জন্য ছাড়া শ্রমবাজারে খুব বেশি চাহিদা নেই দিনমজুর বা শ্রমিকদের। পেঁয়াজ ও ধানের মৌসুমে শ্রমিকের চাহিদা থাকে ব্যাপক। কাশিনাথপুর হাট ছাড়াও প্রতিবছর পেঁয়াজ ও ধান কাটা, লাগানোর মৌসুমে উপজেলার সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর ইউনিয়নের খয়েরবাড়ি গ্রামের নিমতলা ও বেড়া পৌর এলাকার ডাকবাংলা ঘাটেও প্রতিদিন শ্রমিক বিক্রি হয়ে থাকে।
শ্রমিক ও মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাশিনাথপুর হাটে সপ্তাহে রবিবার ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রম বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খেটেখাওয়া মানুষ জীবিকার তাগিদে এ হাটে জড়ো হয়। দুরদূরান্তের অনেক শ্রমিকেরা হাটবারের আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় এখানে এসে সকালে হাটে দাঁড়ান। প্রকৃত খেটে খাওয়া ও অভাবী মানুষেরাই কেবল এ হাটে নিজেদের বিক্রি করতে আসেন। বাজারে ক্রেতার সংখ্যা বাড়লে শ্রমের দাম বেড়ে যায়। সারাদিনে নিজেকে বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই বাড়ি ফিরে যান।
শ্রম ক্রয় করতে আসা মালিকদের সঙ্গে দরদাম চুক্তি করে তারা জেলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ফসলি মাঠে কাজ করতে যাচ্ছেন। ওই মালিকদের কাজ শেষ হওয়ার পর আবার তারা হাটবারে এসে হাটে হাজির হন। মালিকদের সাথে শ্রমিকরা চুক্তি করে নেন। কাজ শেষে আমাদের হাটবারে ছেড়ে দিতে হবে। প্রতিহাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাটে হাজারেরও বেশি শ্রমিক বিক্রি হয়।অনেকে কোন কোন মালিকের বাড়ি এক দেড় মাস কাজ করে বাড়ি ফিরে যান। যে শ্রমিকদের কাজের হাত ও আচার ব্যবহার ভালো তাদের এক মালিকের কাজ শেষ হলেই ওই গ্রামেরই অন্য কৃষককেরা তাদের কাজে নেয়। উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করতে আসে এ হাটে। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর,বেলকুচি,লাহিরীমোহনপুর, মানিকগঞ্জ,নাটোর,বগুড়া,রংপুর,দিনাজপুর ও পাবনার বিভিন্ন উপজেলার খেটে খাওয়া শ্রমিকরাও আসেন এ হাটে।
শ্রম বিক্রি করতে আসা সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোরজনা গ্রামের মাহাতাব আলী জানান, সবকিছুরই দাম বাড়লো। আমাগো দাম বাড়লো না বাপু। আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এ হাটে কামলা বেছি। সকালে হাটে আইচি। গিরেস্ত পাট নিড়ানোর কামে দিন সাড়ে চারশ’ টাকা করে দাম কয়। এই গরমে এতো কম দামে কাম করে পোষায় না। সামনে ঈদ।সংসারে মেলা খরচ। পাঁচশ’ করে হলে কামে যামু। এ আশায় দাঁড়িয়ে আছি।
নাটোর থেকে হাটে শ্রম বিক্রি করতে আসা আজাহার আলী জানান, বৃহস্পতিবার ভোরবেলা বাড়ি থেকে হাটে আইচি আমরা মোট সাতজন। মালিকদের সঙ্গে দামে মিল না পড়ার কারণে আমরা দুপুর পর্যন্ত বসে আছি। কারণ মালিকেরা দিনে তিনবার খাবার দিয়ে প্রতিদিন চারশ’ টাকা করে দাম দিতে চায়। এতো কম দামে কাজ করে সংসার চালানো কষ্ট হয়। তাদের নিজস্ব কোনো আবাদি জমি না থাকায় তাদের প্রায় সারা বছরই দিন মজুরি খেটে খেতে হয়।
সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার আইউব আলী (৭৫) বলেন, ১৫ বছর বয়স থেকে এ হাটে কামলা বেচার জন্য আসি। ৫০ টাহা দিন কাম করে সংসার চালাতে কষ্ট হয় নাই। কিন্তু এহন ৫০০ টাকা দিন কামলা দিয়েও সংসার চলে না।আমার সংসারে দুই মেয়ে, এক ছেলেসহ মোট পাঁচজন খানেওলা। এক মাসে ১০ দিনও কাম হয় না। পাঁচদিন কাম না করলি না খেয়ে থাকা লাগে। কাজ না থাকায় ৫০০ টাকার মজুরি ৪০০ টাকায় নেমে গেছে।
হাট থেকে ১৫ জন শ্রমিক নিয়ে যাওয়া দুলাই ইউনিয়নের চিনাখরা গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ বলেন, আমার গাজনার বিলে দশ বিঘা পাট আছ। টানতে (নিড়াতে) হবে। পাঁচ বিঘা তিল আছে, কাটতে হবে। তাই দিন হাজিরা পাঁচশ’ করে ১৫ জন শ্রমিক নিছি। প্রায় দশ দিনের কাজ আছে। এলাকার শ্রমিকের দামের চেয়ে হাটের শ্রমিকের দাম এক দেড়শ’ টাকা কম। তাই হাটে আসা। হাটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা গিরেস্ত মানুষ।আমার দাদাও এই কাশিনাথপুর হাট থেকে কামলা নিতো। এই হাট দুইশ’ বছরেরও পুরোনো বলে তিনি জানান।
এসএইচ